খুশির ছোঁয়া : তপতী সাহা


 

      বোসবাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনিকা, কাপড়ের খুঁটে হাত মুছতে মুছতে গলির মুখে এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ী, শ‍্যামলা, দোহারা স্বাস্থ‍্য, মাঝারি গড়ন, দেখতে মন্দ নয়। যেন পাথর কুঁদে তৈরী করা হয়েছে এমনই গম্ভীর এক শান্ত প্রতিমূর্তি।


শরৎকাল। আকাশে কী সুন্দর পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আনাগোনা! সূর্যের কিরণ তাকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে। তারই মাঝে কতো রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে! মনিকার অবশ‍্য এসব দেখার একদমই সময় নেই। সে আকাশের দিকে একবার ভালো করে তাকাল। মনে হয় বেলা আন্দাজ করবার জন‍্য। সেই কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে সে। আজ মহালয়া, তার উপর বিশ্বকর্মা পুজো। এমনটা অবশ্য কোনোবার হয় না। এবারে কীসব তিথি নক্ষত্র পড়েছে। 


বাবুদের বাড়ি কাজের চাপও বেশি, তাই আজকে একটু বেশি ভোরবেলাতেই বেরিয়েছে সে। এমনিতে সে সকাল সকালই বেরোয়। এদিকে মাথার উপর রোদ চড়ে গিয়েছে, শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে সে জোরে পা চালায়। 

"মনিকা, এই মনিকা..."

ডাক শুনে সে পেছন দিকে তাকাল। পাশের গলি থেকে খুকু বেরিয়ে আসছে। পরনে একটা রংচটা সালোয়ার কামিজ।

মনিকাকে জিজ্ঞেস করল,"কাজ হয়ে গেল?"

"নারে এখনও একটা বাড়ি বাকি আছে।"

"এরপর তুই তো অসুস্থ হয়ে পড়বি রে। একটা দুটো বাড়ির কাজ তো ছেড়ে দিতে পারিস।"

"ছাড়লে হবে? সংসারটা কেমন করে চলবে তাহলে? তোর হয়ে গেল?"

"হ‍্যাঁ, আমার অতো পোষায় না। বড় জোর দুটো বাড়ি। তুই পাঁচ পাঁচটা বাড়িতে... কি করে অতো পারিস রে!"

কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে যায়।

মল্লিকবাড়ির কাছাকাছি আসতেই খুকু বলে, "তাহলে তুই কাজ সেরে আয়। আমি বাড়ির দিকে এগোলাম।"

খুকু চলে যায়। মনিকা মল্লিক বাড়িতে ঢোকে। সে বলল বটে, কিন্তু আজকাল তার শরীরটা মাঝেমধ্যেই বিদ্রোহ করে ওঠে।  সকালে খানিকটা করে দিয়ে যায়, অন্যান্য বাড়ির কাজ সেরে ফেরার পথে আবার এসে এই বাড়িতে ঢোকে। এখন শুধু ঘর পোছা ও বাসনগুলো ধুয়ে দিলেই হবে। 


সব কাজ সেরে যখন সে বেরোল সূর্যদেব মাথার উপর। কটা বাজল? হয়তো ১টার কাছাকাছি হবে।বাড়ি ফিরে দুটো চাল ফুটিয়ে নিতে হবে।

সব বাড়ি থেকে কিছু কিছু টিফিন দেয়, সাথে কিছু তরকারিও থাকে। কোনো কোনো দিন ওই দিয়েই চালিয়ে নেয়। তবে সবদিন কি আর সমান হয়।

তাছাড়া ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনা করে, একটু ভালো খাওয়া দাওয়াও তো ওদের দরকার। কোনো কোনো দিন ফেরার পথে বাজার থেকে দুএক পিস মাছও নিয়ে যায়।


পা চালিয়ে মনিকা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখে দুই ভাই বোনে মিলে খবরের কাগজ, তার সাথে রঙিন কাগজ, ঝাঁটার খিল, সুতো, আটার আঠা এসব নিয়েই পড়ে আছে। কদিন থেকে সে লক্ষ্য করছে এগুলো।

মাকে দেখে ওগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করে ওরা।

"এই টুম্পা, বাবলু আজও তোরা ময়দা নষ্ট করেছিস? রোজ রোজ ভালো লাগে না। ময়দার কি দাম নেই। কত কষ্ট করে এইগুলো যোগাড় করতে হয় জানিস তোরা!" রাগের চোটে কটা কড়া কথাও শুনিয়ে দেয় সে।


"স্নান করেছিস?"

টুম্পা ও বাবলু মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

"তার মানে হয়নি। টুম্পা তুই তো একটু স্নান সেরে ভাতটাও চাপাতে পারতিস।"

মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে, ওরা সবকিছু গুটিয়ে স্নানে যায়।


মনিকা স্নান সেরে রান্নাটা সেরে নেয়। ভাবে, করোনা আর লক ডাউনের জন্য সব বাড়ির গিন্নীমারা এখন একবেলা কাজ মেনে নিয়েছে, না হলে দুটো মুখে দিয়ে আবার ছুটতে হতো। সে ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকে। খাওয়ার সময় ওদের মন খারাপ করা কালো মুখগুলো দেখে ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ভাবে, সত‍্যিই বড্ড বেশী শাসন করা হয়ে যায় ওদের। এখন তো ওরা ছেলেমানুষ, খেলে বেড়ানোর সময়। সেও তো ছোটবেলায়...


সবাই বলে সে বড় গম্ভীর, রাগীও। একদমই মিশুকে নয়। খুব দরকার ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। তার সাথে কথা বলে সব কথার উত্তরও পাওয়া যায় না। যদি একটা শব্দে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় সে তাই দেয়। ছেলেমেয়েগুলোও তাকে দেখে ভয়ই পায়।


কিন্তু চিরকাল তো সে এরকম ছিল না। দিব‍্যি হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল মেয়ে ছিল সে। বাপের আদুরে, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গেই যত আদর আবদার, খেলাধুলা চলত। কিন্তু একটু বড় না হতেই বাপটা গেল মরে। অনেকগুলো ভাইবোন নিয়ে তার মা পড়লেন অথৈ সাগরে। অভাবের তাড়নায় স্কুল যাওয়া, পড়াশোনা সব বন্ধ হয়ে গেল তাদের। সবার মধ্যে সেইই বড়ো। ষোল না পেরোতেই পাশের গাঁয়ে ছেলে দেখে মা বিয়ে দিলেন। শ্বশুরবাড়ি এসে সে অল্পদিনেই সবাইকে মানিয়ে নিল বটে, শুধু মানাতে পারল না নিজের বর পলাশকে। দিন রাত শুধু শুয়ে বসে থাকে। একদিন কাজে যায় তো সাতদিন ঘরে বসে থাকে। সংসারের চিন্তা তার একদমই নেই। দেখতে দেখতে তার দুটি ছেলেমেয়ে জন্মেছে। সংসারের লোকসংখ্যা বেড়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন খারাপ নয়। শ্বশুর শাশুড়ি, দেওর জা, ননদেরা তাকে ভালোই বাসে। পলাশ কুঁড়ে, অলস তাই সে যতটা পারে গায়ে গতরে খেটে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সারাজীবনের দায়িত্ব কি কেউ কারো নেয়! তাদেরও নিজ নিজ সংসারের চিন্তা আছে। ফলে সবাই হাড়ি আলাদা করে নেয়।


মনিকা নিজে কর্মমুখী ও সংসারী মেয়ে। কুঁড়েমি তার একদমই পছন্দ নয়। পলাশের সঙ্গে যখন কিছুতেই পেরে  উঠলো না, তার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়ার মুখে লাথি মেরে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এল। মাসির বাড়ি শহরে। সে মাসির সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানে চলে গেল। মাসিও এক বাড়িতে আয়ার কাজ করে। ভাবল, কাজই যখন করে খেতে হবে, স্বাধীন ভাবে লোকের বাড়িতেই কাজ করবে। এতে তার দুপয়সা আসবে। পলাশের ভরসায় থাকলে ছেলেমেয়ে দুটিকে মানুষ করতে পারত না। মাসির বাড়িতে থেকেই সে কাজ শুরু করেছিল। এখন টাকার বিনিময়ে তার থাকার ঘরটা নিজের করে নিয়েছে। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে গত বছর ইট গেঁথে ঘর পাকাও করেছে।


ভদ্রপাড়ার এক কোনে এইরকম কয়েকঘর লোকের বাস। এরা খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ রিকশা ভ‍্যান চালায়, কেউ বা মালিকের গাড়িতে ড্রাইভারের কাজ করে। আর তাদের বৌ ঝিয়েরা সংসারে অভাবের কারণে বাবুদের বাড়িতে রান্নার কাজ বা ঝিয়ের কাজ করে। অবশ্য এদের ছাড়া সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা অচল। তাই দৃষ্টি দূষণ হলেও তাদের প্রয়োজনেই এই মহল্লাটি থেকে গেছে।


মহল্লায় সবার মধ্যে মনিকার কাজের চাহিদা বেশি। একবার যে বাড়িতে সে কাজ করতে ঢোকে সহজেই সবার মন জয় করে নেয়, ফলে তাকে কেউ আর ছাড়তে চায় না। 

সে সৎ, বিশ্বাসী, মন দিয়ে কাজটা করে, কথা বলেও কম, ভদ্র এবং বিনয়ী। সহজেই সবার মধ্যে থেকে তাকে আলাদা করা যায়। মহল্লার সবার সঙ্গে একটু দুরত্ব বজায় রেখেই সে চলে। সবার নজর তো সমান নয়। সেইজন্যই হয়তো নিজের চারপাশে অদৃশ্য এক আবরণ তৈরি করে রেখেছে।ছেলেমেয়ে দুটিকেও সবার সঙ্গে মিশতে দেয় না। ভাবে কুসঙ্গে পড়ে যদি বাপের ধারা পেয়ে যায়।

সবাই প্রথম দিকে তাকে দেমাকি ভাবত, এখন তার দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকায়। তার ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে, মেয়েকে নাচ শেখাতে দিয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকও পায়। স্বপ্ন দেখে টুম্পা ও বাবলু যেন ভালভাবে মানুষ হবে। অন্তত তার মতো কষ্টের জীবন যেন ওরা না পায়।


প্রথম দিকে পলাশ এসে ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে চলে যেত, আর আসতে দিতো না। মনিকা আবার গিয়ে জোর করে আনত। এখন ওরা আর যেতে চায় না। পলাশ এসে মাঝেমধ্যেই  ঝামেলা করে, হয়তো আঁতে ঘা লাগে। যে কাজ তার করার কথা, মেয়ে হয়ে সে কাজ মনিকা করছে দেখে। মনিকা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি ভালোভাবে থাকতে চাও তো এসো, কিন্তু দোহাই তোমার ওদের ভবিষ্যত নষ্ট করার চেষ্টা কোরো না। এদিকে আর অনেকদিনই আসেনি সে। নাঃ, সে ওদের জীবনে বাবা মা দুজনেরই অভাব পূরণ করবে।


খেতে খেতে ছেলেমেয়েকে বলে,"তোদের ঘুড়ি বানানো হল।"


টুম্পা, বাবলু চমকে তাকায়। মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখে সাহস পায়। বলে,"কই আর হল! জানো মা কদিন ধরে চেষ্টা করছি, ঠিকঠাক হয়েই উঠছে না।"


অভাবের সংসারে ঘুড়ি কেনার বিলাসিতা করে পয়সা নষ্ট করতে মন চায় না। ছেলেমেয়েও সেকথা বুঝেছে। মনিকা ভাবে, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘুড়ি তৈরি করাতে কতবার হাত লাগিয়েছে সে। 


"ঠিক আছে, হাত ধুয়ে ওগুলো বের কর আমিও আসছি।"


টুম্পা ও বাবলু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, মা তাদের সঙ্গে ঘুড়ি বানাবে! খুশি হয়ে ওরা বিপুল উদ‍্যমে লেগে পড়ে। কয়েকবারের চেষ্টায় তৈরিও করে ফেলে ঘুড়ি। তাতে চোখমুখ একে দেয় ও নকশা কাটা ঘুড়ির লেজটা লাগিয়ে দিয়ে লাটাই এর সাথে সুতো জুড়ে দেয়। এবার শুধু ওড়ার অপেক্ষায়।


তিনজনে পরিপাটি হয়ে সামনের মাঠে ঘুড়ি, লাটাই নিয়ে চলে যায়। ওরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ কত রকমের ঘুড়ি উড়ছে। বাবলু ঘুড়িটা ধরে, মনিকা লাটাই থেকে আস্তে আস্তে সুতো ছাড়তে ছাড়তে বলে, এবার উড়িয়ে দেখ তো। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ঘুড়ি ওপরে ওঠে। বাবলু ও টুম্পা আনন্দে লাফিয়ে উঠে।  ওদের আনন্দ দেখে মনিকার খুব ভালো লাগে। ভাবে এমনি করেই যদি তার স্বপ্নগুলো ওই নীল আকাশে ডানা মেলে উড়তো... আস্তে আস্তে সুতো ছাড়তে ছাড়তে সে বাবলুকে বলে,"এবার তুই ধর।"  টুম্পা বলে, মা আমি? 


"আচ্ছা, একে একে হবে। একবার দাদা, একবার তুমি কেমন?"


মনিকা যেন আজ ছেলেমেয়েদের সাথে তার মেয়েবেলাটা ফিরে পায়। তার মুখে হাজার প্রদীপের আলো জ্বলে ওঠে। টুম্পা ও বাবলু মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখে ভাবে, এই ঘুড়ি ওড়ানোর দৌলতে  মায়ের মুখে হাসি তো ফুটল। মাকে বলবে তুমি এমনি ভাবেই থেকো মা। আমরা তোমার সব কথা শুনে চলব।


মহল্লার সবাই সেই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায়। এ এক অন‍্য মনিকাকে ওরা দেখছে। সবাই মিলে হৈ হৈ করে ওদের সঙ্গ নেয়। নাঃ, ওরা কোন কাটাকুটি বা ভৌকাট্টা খেলায় মাতে না।


কার ঘুড়ির রঙ কী? কারটা কতদূর গেল? এই উচ্ছ্বাসেই ওরা মেতে ওঠে। মনে হয় এই আনন্দ যেন ওদের শতজয়ের আনন্দের সমান। এই সব ছোটখাটো খুশির ছোঁয়াই তো ওদের চলার পথে পাথেয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post